গত ২৪শে অক্টোবর বাংলার অন্যতম জনপ্রিয় ওটিটি প্লাটফর্ম ‘হইচই’তে মুক্তি পায়, অর্পণ গড়াই পরিচালিত এবং অনির্বাণ ভট্টাচার্যের সৃজনশীল পরিচালনায় নির্মিত, “তালমার রোমিও-জুলিয়েট”| উইলিয়াম শেক্সপীয়ারের বিশ্ব-বিখ্যাত ট্রাজেডির উপর ভিত্তি করে তৈরী করা হলেও, তালমার রোমিও-জুলিয়েট আসলে আমাদের সক্কলের খুব চেনা কোনো এক মফস্বলের গল্প, খুব চেনা কিছু মানুষের গল্প, খুব চেনা অম্ল-মধুর প্রেম-বিরহের গল্প |
তালমা নামক একটি ছোট্ট জায়গা আসলেই রয়েছে নর্থ বেঙ্গলের জলপাইগুড়ি জেলায় | সেখান থেকেই এই ওয়েব-সিরিজের নামের উৎপত্তি | তবে “তালমা” নামক যে শহর কে স্ক্রিনে দেখা যায়, সেটা বড্ডো পরিচিত, হয়তো প্রত্যেকেই সেখানে থেকেছে একসময়, বা অন্তত শুনেছ তার কথা | এমন একটা ছোট্ট-শহর যেখানে সন্ধ্যেবেলা সার্কাসে বিভিন্ন খেলা দেখানো হয়, যেখানে ছুটির দিনে স্কুলের মাঠে বার্ষিক ফুটবল টুর্নামেন্ট হয়, যেখানে ঘরে ঘরে বাণিজ্যিক বাংলা ছবি দেখা হয় রোজ |
অথচ, খুব পরিচিত মফস্বল শহরের গল্প, খুব পরিচিত প্রেমের গল্প হলেও, তালমার রোমিও-জুলিয়েট একটি বাংলা ওয়েব-সিরিজ হিসেবে খুব আলাদা (এবং আকর্ষণীয়) হয়ে যায় কিছু কিছু বিশেষ জায়গায় | তাহলে কি সেই বৈশিষ্ট যা তালমার রোমিও-জুলিয়েট কে আলাদা পরিচয় দেয় ? আসুন, চট করে এমন পাঁচটি মূল বিষয় নিয়ে কথা বলে নেওয়া যাক |
1. সিনেমাটিক্যালি কাব্যিক ওপেনিং সিকোয়েন্স : যে কোনো ভালো সিনেমা বা ওয়েব-সিরিজের ওপেনিং সিন বা ওপেনিং সিকোয়েন্স কিছু না বলেই অনেক কিছু বুঝিয়ে দিতে পারে | এই ক্ষেত্রে তালমার রোমিও-জুলিয়েটের ওপেনিং সিকোয়েন্স বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য | দুর্দান্ত সিনেমাটিক কিছু ক্লোজ এবং লং শট কে পাশাপাশি ব্যবহার করে যেন এক অদ্ভুত সুন্দর কাব্য রচনা করতে চাওয়া হয়েছে | এই কাব্য-গঠনে আরও সৌন্দর্য আরোপ করেছে, একই সাথে চলতে থাকা, বয়ে যাওয়া সময় নিয়ে লেখা ছোট ছোট কিছু স্টেটমেন্ট | ওপেনিং সিকোয়েন্সটা শুধু সুন্দর বললে বোধয় বড্ডো কম বলা হয় |
2. যথার্থ ডায়ালেক্ট বা উপভাষার ব্যবহার : তালমার লোকজন কলকাতার বাংলা ভাষায় কথা বলে না | তারা আসলে বাংলার একটি বিশেষ উপভাষায় কথা বলে | এক্ষেত্রে অরিজিনাল তালমা উত্তর বঙ্গে অবস্থিত হওয়ার কারণে উত্তর বঙ্গের একটি বিশেষ ডায়ালেক্ট বা উপভাষা হয়ে ওঠে তালমার লোকজনের (এক্ষেত্রে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের) রোজকার দিনযাপনের এবং কথোপকথনের ভাষা | এই ডায়ালেক্ট বা উপভাষার ব্যবহার প্রায় নির্ভুল এবং অত্যন্ত যথাযত | এই উপভাষার ব্যবহারের ফলে সম্পূর্ণ আলাদা মাত্রা যোগ হয় গল্পের আনাচে কানাচে, প্রতিটি চরিত্র যেন আরও বেশি জীবন্ত হয়ে ওঠে একটু একটু করে |
3. মূল-চরিত্র এবং পার্শ্ব-চরিত্রদের প্রকৃত-অর্থে সহাবস্থান : তালমার রোমিও বা রানা (দেবদত্ত রাহা) এবং জুলিয়েট বা জাহানারার (হিয়া রায়) পাশাপাশি তালমায় স্ক্রিনজুড়ে রয়েছে বেশ কয়েকজন ছোটো-বড়ো চরিত্র | এই ক্ষেত্রে লক্ষণীয় বিষয়, এই ওয়েব সিরিজে প্রতিটি চরিত্রের নিজের নিজের পরিচয়ের সাথে সাথে রয়েছে নিজের নিজের বিশেষ স্থান (বা স্পেস) | সেই একান্তই নিজস্ব স্থানে কোনো চরিত্র বড়ো বা ছোট নয়, বরং প্রত্যেকেই নজর কাড়ে আলাদা আলাদা ভেবে | সমস্ত ছোট-বড় চরিত্রদের আক্ষরিক অর্থেই সহাবস্থান ঘটাতে সফল হয়েছে এই ওয়েব সিরিজের প্লট এবং কাহিনী | সমস্ত চরিত্রের মধ্যেই রয়েছে খুব চেনা কোনো মানুষের ছাপ এবং একই সাথে বিভিন্ন অভিনেতা অভিনেত্রীদের অভিনয় অদ্ভুতভাবে আকর্ষণীয় করে তোলে এই সব চরিত্রদের | বিশেষ ভাবে আকর্ষণীয় চরিত্রদের মধ্যে অন্যতম হল রানার দাদা সোমনাথ মজুমদার (অনুজয় চ্যাটার্জী), রানার বৌদি (পায়েল দে) এবং জাহানারার ক্ষমতাশালী বাবার রাইট-হ্যান্ড ম্যান, মোস্তাক (অনির্বান ভট্টাচার্য) |
4. মনে রেখে দেওয়ার মতো কিছু পাওয়ারফুল সিন বা দৃশ্য : তালমার রোমিও জুলিয়েট এমনভাবে তৈরী করা হয়েছে যাতে বেশ কিছু দৃশ্য, কিছু চরিত্র, কিছু ডায়ালগ, এবং কিছু অনুভূতি সিজির শেষের পরেও দর্শকের মনে গেঁথে থেকে যাওয়াটা নিশ্চিত | ওপেনিং সিকোয়েন্স নিয়ে আলাদা কিছু না বললেও, আলাদা করে উল্লেখ করতেই হয় শুরুর দিকে বিভিন্ন চরিত্রের ইন্ট্রোডাকশন সিকোয়েন্স এবং সেই সময় ব্যবহৃত যথাযত গ্রাফিক্সের কথা | শুরুতেই তাক লাগিয়ে দেয় পরিচালক | এ ছাড়া রয়েছে সোমনাথ-মোস্তাকের বেশ কিছু ফেস-অফ দৃশ্য যা দুজন তুখোড় অভিনেতার অভিনয়ে জীবন্ত হয়ে ওঠে স্ক্রিনজুড়ে| রানা-জাহানারার প্রেম, ঝামেলা, মনখারাপ, মিটমাট, কান্না, হাঁসি – সবটাই খুব রিয়েল, খুব রিলেটেবল| বিভিন্ন চরিত্রদের মধ্যে বেশ কিছু কথোপকথনের দৃশ্য রয়েছে যা হারিয়ে যাওয়া মফস্বলের জীবন কে ফিরিয়ে আনে স্ক্রিনে | বিশেষভাবে নজর কাড়ে সিরিজের শেষের দিকে কিছু বিশেষ দৃশ্য (এবং ডায়ালগ) যা তালমার এই গল্পকে আঞ্চলিকতার বাউন্ডারি ভেঙে করে তোলে শাশ্বত, সার্বজনীন এবং চিরন্তন প্রেম-বিরহের আখ্যান |
5. প্রেমের গল্পের সাথে রোমান্টিক্যালি সুইটেবল প্রেমের গান : প্রেমের গল্পের সাথে অনায়াসে মিশে যেতে পারা প্রেমের গান হল সুন্দর করে সাজানো কেকের উপর টকটকে লাল সেই চেরি-টা, যা কেকের আকর্ষণীয়তা কে বহুগুন বাড়িয়ে দেয় নিমেষেই | তালমার রোমিও-জুলিয়েট-এর ক্ষেত্রেও কিছু অনবদ্য প্রেমের গান অনায়াসে মিলেমিশে যায় প্রেমের গল্পের অলি-গলিতে | দেবরাজ ভট্টাচার্য, শুভদীপ গুহ, দেবায়ন ব্যানার্জী, অনির্বান ভট্টাচার্য – সকলে মিলে অদ্ভুত সুন্দর কিছু গান নির্মাণ করে, যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে গল্পের অংশ হয়ে যায় | প্রতিটা গান কানে শুনতে এবং স্ক্রিনে দেখতে ভালো লাগবেই লাগবে | বিশেষ উল্লেখ – দেবায়ন ব্যানার্জীর গলায় “লাল রঙ” গানটির একাধিক বার সুন্দর ও যথাযত ব্যবহার আলাদা করে গানটিকে অন্য গভীরতায় নিয়ে যায়, গল্পের সাথে জুড়ে দেয় আলাদা মাত্রা |
***স্পেশাল মেনশন – শুরুর দৃশ্যের সাথে একেবারে শেষের দৃশ্য মিলেমিলে একাকার হয়ে যায় ভয়ঙ্কর-সুন্দরভাবে এবং চিরকালীনের এক কঠিন সত্যি বয়ান করে দিয়ে যায় কিছু দুর্দান্ত সিনেমাটিকে শট, ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর এবং স্ক্রিনের ওপর সামান্য কিছু টেক্সটের মধ্যমে | এই শুরুর দৃশ্যের সাথে শেষের দৃশ্যের সাবলীলভাবে মিশে যাওয়ার এই ব্যাপারটা সচরাচর বাংলা সিনেমা বা সিরিজের ক্ষেত্রে খুব একটা দেখা যায় না বললেই চলে | এক্ষেত্রে মেকারদের ক্রিয়েটিভিটির আরও একটা দিক উন্মোচিত হয় খুব সিনেমাটিক্যালি |
সব কাজেরই ভালো-মন্দ থাকে | তালমার রোমিও-জুলিয়েট-এর ক্ষেত্রেও এই একই কথা প্রযোজ্য | কিন্তু এটা এমন একটা কাজ যেখানে ভালোগুলো অনেকাংশে ঢেকে ফেলতে সফল হয়েছে খারাপের ছায়াগুলোকে | একটি নির্মেদ প্রেম-বিরহের গল্পের সাক্ষী থাকতে চাইলে এবং কিছু অনবদ্য অভিনেতা অভিনেত্রীদের অভিনয় প্রত্যক্ষ করতে চাইলে, অবশ্যই দেখতে হবে তালমার রোমিও-জুলিয়েট | এই বাংলা ওয়েব সিরিজটির সর্বোমোট ছটি এপিসোড “হৈচৈ” নামক ওটিটি প্লাটফর্মে পাওয়া যাবে সাবক্রিপশনের ওপর ভিত্তি করে, যদিও প্রথম এপিসোডটি একেবারে ফ্রি |
ইংরিজি লিটারেচারে অনার্স এবং মাস্টার্স কমপ্লিট করার পরে একান্ত নিজস্ব ইন্টারেস্ট থেকে মাস কমিউনিকেশন নিয়ে পোস্ট-গ্রাজুয়েট ডিপ্লোমা | তারপর বিভিন্ন বেসরকারি চাকরির বেড়াজাল পেরিয়ে লেখালিখি করার আপ্রাণ চেষ্টা | আপাতত পেশায় ফ্রিল্যান্স কনটেন্ট রাইটার এবং নেশায় সিরিয়াল প্রোক্রাস্টিনেটর |