Live Entertainment & Love Lifestyle

Friday, April 11, 2025
Theatre

‘স্যারের পা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, শেষদিন পর্যন্ত থিয়েটার করব’

ছয়জনের পরিবার, ছয়জনেই শিল্পী। তার মধ্যে আবার পাঁচজনেই যুক্ত অভিনয়ের সঙ্গে। খোলামেলা আড্ডায় নিজের গল্প বলছিলেন সুস্নাত ভট্টাচার্য্য।

সম্প্রতি দেখতে গিয়েছিলাম ‘সন্দীপনী’ নামে একটি নাটক। সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সেই নাটকে আমার নজর কেড়েছিলেন অভিনেতা সুস্নাত ভট্টাচার্য্য। চে গেভারাকে যেন নিজের অন্তরে ধারণ করেছিলেন তিনি। সেই অভিনয় দেখে, একটু আড্ডা দেওয়ার লোভ কি আর সামলানো যায়? তাই কথা হচ্ছিল ‘চে’ ওরফে সুস্নাতর সঙ্গে।

কথা অবশ্য যত না হচ্ছিল, তার চেয়ে অনেক বেশী চেষ্টা চলছিল স্মৃতির সরণী বেয়ে কিছুটা পিছনদিকে হাঁটার। অভিনয়জগতের সঙ্গে ঠিক কীভাবে যুক্ত হওয়া তাঁর? ঠিক কতটা ভালবাসলে এত চড়াই উতরাই পেরিয়েও টিকে থাকা যায় কেবল অভিনয়ের কাছেই? প্রতিজ্ঞা করা যায়, শেষদিন পর্যন্ত অভিনয় করার!

জানলাম, থিয়েটারে যে কোনোদিন অভিনয় করবেন, তা স্বপ্নেও ভাবেননি সুস্নাত। তবে থিয়েটারের প্রতি তাঁর ভালবাসা ছোট থেকেই। বাবা দেবব্রত ভট্টাচার্য্যের সান্নিধ্যে আর ‘সমকালীন শিল্পীদল’-এর ‘তোমাকে চাই’ দেখেই নাটকের প্রেমে পড়েছিলেন তিনি। তৈরী হয়েছিল থিয়েটার দেখার অভ্যাস।

তবে নিজে কোনোদিন অভিনয় করবেন, তা কিন্তু ভাবেননি তিনি। আসলে জীবন যে কার জন্য ঠিক কী পরিকল্পনা করে রেখেছে, তা তো আর আগে থেকে জানা যায় না! দেবশঙ্কর হালদার, গৌতম হালদার, এবং আরো অনেককে দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন তিনি। অথচ অনেক পরে, রমাপ্রসাদ বণিকের নির্দেশনায় ‘একলা পাগল’ নাটকে রাজেশ্বরী নন্দীর অভিনয় দেখাই কীভাবে যেন অভিনয় শেখার ইচ্ছেটা মাথাচাড়া দিয়েছিল সুস্নাতর ভিতরে।

কোনোকিছু চেয়ে না পাওয়ার দুঃখের থেকেও হয়ত অনেকটা বেশী পেয়ে হারিয়ে ফেলার দুঃখ। বাবার হাত ধরে ‘সমকালীন শিল্পীদল’-এ যোগ দিলেও, ভাগ্য একেবারেই সুপ্রসন্ন ছিল না। কিছুদিন পরে, আচমকাই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল এই নাট্যদল। বাবা তাঁর পুরনো নাট্যদলে ফের যোগ দিলেও, সে সুযোগ হয়নি সুস্নাতর। অভিনয়ের থেকে দূরে সরে যেতে যেতে মনে মনে ভেঙে পড়ছিলেন তিনি।

মনখারাপ সবসময়েই বড় ছোঁয়াচে। ছেলের কষ্ট, অবসাদ স্পর্শ করেছিল বাবাকেও। আর সেজন্যই তিনি যোগাযোগ করেছিলেন অভিনেতা দ্বিজেন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। যদিও দ্বিজেন বন্দ্যোপাধ্যায়ের মঞ্চাভিনয়ের নৈপুণ্যের কথা তখন জানা ছিল না তাঁর। ২০১০ সালে এক নাটকের রিহার্সালে তাঁকে দেখেন সুস্নাত। আর তারপরেই দ্বিজেনবাবু হয়ে ওঠেন তাঁর গুরু, তাঁর ‘স্যার’।

অনেকটা সিনেমার, থুড়ি থিয়েটারের মতই চলেছিল পরের পাঁচবছর। দ্বিজেনবাবুর নাট্যদল ‘সংস্তব’-এ যোগ দিয়েছিলেন সুস্নাত। কিন্তু শোয়ের সংখ্যা একেবারেই কম হওয়ায় অভিনয়ের ক্ষিদেটা যেন সম্পূর্ণ মিটছিল না! বন্ধু অনুভব ছিলেন নাট্যদল ‘হিপোক্রিটস’-এর অন্যতম সদস্য। সেই দলের একটি নাটক দেখেই অনুভবের সঙ্গে কাজ করার ইচ্ছে হয়েছিল তাঁর।

কঠিন সময় একসঙ্গে পেরোলে বন্ধুত্ব হয়ত একটু বেশীই গাঢ় হয়, তাই না? আর আমাদের পেশা-প্যাশনের যুদ্ধে সেই গাঢ় বন্ধুত্বগুলো অজান্তেই হাত ধরে আমাদের। অনুভব-সুস্নাতর গল্পটাও অনেকটা একরকম। একই অফিসে কাজ করতেন দু’জনে। অভিনয়ের তাগিদে চাকরী ছেড়েও দিয়েছিলেন একসঙ্গেই। প্রথমে একটু মনখারাপ হলেও, পরে ‘স্যার’-এর সম্মতিতেই অনুভবের লেখা ‘হিপোক্রিটস’-এর একটি নাটকে মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি।

‘সংস্তব’-এর পাশাপাশি সুস্নাত ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়ছিলেন ‘হিপোক্রিটস’-এর সঙ্গেও। কিন্তু ২০১৪ সালে ফের আসে এক অকল্পনীয় বিপর্যয়। আর্থিক ও অন্যান্য নানা সমস্যায় ভেঙে যায় ‘হিপোক্রিটস’। সেইসময়ে অদ্ভুতভাবে ফিরে আসে তাঁর একটুকরো ছোটবেলা। ছোটবেলায় সরস্বতীপুজোয় সুব্রত নন্দী নির্দেশিত ‘ভজ গৌরাঙ্গ কথা’ নামে একটি হাসির নাটকে অভিনয় করেছিলেন সুস্নাত। এতবছর পরে, ফের সেই নাটকের হাত ধরেই কিছুটা ঘুরে দাঁড়ায় ‘হিপোক্রিটস’।

মঞ্চে অভিনয় করে বহু প্রশংসা কুড়িয়েছেন সমালোচকদের কাছ থেকে। লিখেছেন কিছু নাটক, করেছেন পরিচালনাও। ক্যামেরার সামনেও বেশ কিছু ওয়েবসিরিজ, ধারাবাহিক এবং সিনেমায় কাজ করেছেন তিনি। কিন্তু কোনোভাবেই মাটির উপর থেকে পা সরেনি সুস্নাতর। অভিনেতা বলছিলেন, ধাপে ধাপে একেকজনের কাছ থেকে কীভাবে বিভিন্ন কাজ শিখেছেন, বকুনি খেয়েছেন, স্নেহ-ভালবাসা-প্রশ্রয় পেয়েছেন, সবই বলছিলেন অভিনেতা।

আসলে, আমাদের জীবনে একেকজন মানুষ আসেন বিভিন্ন সময়ে। কেউ থেকে যান, কেউ চলেও যান হয়ত স্বল্পসময়ের পর। কিন্তু তাঁরা সকলেই হয়ত কিছুটা ছাপ রেখে যায় আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির উপর। আর সেই মানুষগুলোর কথা কি অস্বীকার করা যায় কোনোদিনই? সুস্নাত ভট্টাচার্য্যও কথা বলতে বলতে বলছিলেন তাঁর জীবনের বিভিন্ন মানুষের কথা। মা-বাবা-স্ত্রী-ভাই-বন্ধু-সহকর্মী থেকে শুরু করে বহু মানুষ জল দিয়েছে তাঁর অভিনয়ের ইচ্ছের চারাগাছটায়। আর সেজন্যই হয়ত সব ঝড়-ঝাপটা সয়েও বড় হয়েছে সেই চারাটা। একদিন আরো কিছু চারাকে ছায়া দেবে বলে!

Author

  • Debasmita Biswas

    বেথুন কলেজ থেকে উদ্ভিদবিদ্যায় স্নাতক। পড়ার নেশা ছোট থেকে, প্রাথমিকভাবে লেখালেখির শুরু শখেই। তারপর সংবাদপত্র, পত্র-পত্রিকায় সমালোচনা পড়ার অভ্যাস আর বিভিন্ন নাটক, সিনেমা দেখার পর বিশ্লেষণ করার শখ থেকেই ইচ্ছে সমালোচক হওয়ার। বিনোদনজগতের বিভিন্ন খবর করার পাশাপাশি নাটক এবং সিনেমা দেখে তার গঠনমূলক সমালোচনাও করেন তিনি।

    View all posts

Debasmita Biswas

বেথুন কলেজ থেকে উদ্ভিদবিদ্যায় স্নাতক। পড়ার নেশা ছোট থেকে, প্রাথমিকভাবে লেখালেখির শুরু শখেই। তারপর সংবাদপত্র, পত্র-পত্রিকায় সমালোচনা পড়ার অভ্যাস আর বিভিন্ন নাটক, সিনেমা দেখার পর বিশ্লেষণ করার শখ থেকেই ইচ্ছে সমালোচক হওয়ার। বিনোদনজগতের বিভিন্ন খবর করার পাশাপাশি নাটক এবং সিনেমা দেখে তার গঠনমূলক সমালোচনাও করেন তিনি।