মাস্টার্স পরীক্ষার ফাইনালের আগেই, আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যপ্রতিযোগিতায় যোগ দিতে চলে গিয়েছিলেন দিল্লীতে। পরীক্ষা আর দেওয়া হয়নি বটে, তবে দলীয়ভাবে প্রথমস্থান অধিকার করার সঙ্গে সঙ্গে জিতেছিলেন সেরা অভিনেতার সম্মানও।
সত্যজিৎ রায়ের আরো বেশকিছু তীক্ষ্ণ আবিষ্কারের মধ্যেই একজন হলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। তাঁর নামটার মধ্যে একটা অদ্ভুত জাদু আছে। নামটা শুনলেই চোখের সামনে অপু – শেখরদা – উদয়ন পণ্ডিত – সন্দীপ – ক্ষিদ্দা – ফেলুদার মুখগুলো চলতে শুরু করে বায়োস্কোপের মত। ষাট বছরের কর্মজীবনে মনে রাখার মত চরিত্রের সংখ্যা তো আর কম ছিল না! প্রথমদিকে পরপর বেশকিছু আর্টফিল্মে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করলেও ১৯৬২-’৬৩ সাল নাগাদ সমান্তরালভাবে বাংলার মেইনস্ট্রিম কমার্শিয়াল ছবিতেও অভিনয় করতে শুরু করেছিলেন তিনি।
তাঁর অভিনয়দক্ষতার কথা আলাদা করে আর বলার প্রয়োজন নেই। ‘কোনি’ হোক বা ‘ঘরে-বাইরে’, ‘শেষ পৃষ্ঠায় দেখুন’ হোক বা শেষবয়সের ‘বেলাশুরু’, কোনো ছবির কোনো একটা দৃশ্যে মুহূর্তখানেকের জন্যও সামান্যতম বিচ্যুতি হয়নি তাঁর অভিনয়দক্ষতার। ‘বসন্ত বিলাপ’ ছবি কিংবা ‘ঘটক-বিদায়’ নাটকে কৌতুক অভিনয়েও ছিলেন কি অসম্ভব সাবলীল। অথচ বিচ্যুতির কি যথেষ্ট কারণ ছিল না? অবশ্যই ছিল!
তাঁর মৃত্যুর পর এক স্মৃতিচারণে পরিচালক শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘‘পোস্ত’র শ্যুটের সময়ে সৌমিত্র বাবুর স্ত্রী অসম্ভব অসুস্থ। হাসপাতালে ভর্তি। ভেবেছিলাম, কাজের দিন পিছিয়ে দেব। কিন্তু কিছু মনস্থির করার আগেই সৌমিত্র বাবু নিজের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছিলেন— ব্যক্তিগত অসুবিধার কারণে ছবির শ্যুট বন্ধ করতে তিনি নারাজ। অগত্যা নির্ধারিত দিনেই শুরু হয়েছিল কাজ। ঘড়ির কাঁটা ধরে পৌঁছে যেতেন সেটে।’ সেই ছবি মুক্তি পাওয়ার আগেই ঘটেছিল আরেক দুর্ঘটনা। পথদুর্ঘটনায় নাতি রণদীপের প্রাণসংশয়ের পরিস্থিতি উপস্থিত হয়েছিল। তা সত্ত্বেও, ছবির প্রচারে উপস্থিত ছিলেন তিনি।
এমন একজন বিখ্যাত মানুষের জীবনে খ্যাতির বিড়ম্বনা থাকবে না, তা কি হয়? তখন সদ্য পিতৃহারা হয়েছেন সৌমিত্র। রয়েছেন ছোটবেলার শহর ‘কেশ্নগরে’ই (কৃষ্ণনগর)। হঠাৎ অচেনা-অজানা এক ব্যক্তি, বেশ কিছুক্ষণ নিরীক্ষণ করার পর, প্রচণ্ড এক চিমটি কাটেন তাঁকে। বিস্মিত-হতভম্ব সৌমিত্রর প্রশ্নের উত্তরে ‘নির্লজ্জের মত’ই জানান, অভিনেতা সত্যিই অতটা ফর্সা কিনা, সেটাই নাকি পরখ করছিলেন তিনি।
জীবনের শেষধাপে পৌঁছেও অস্বাভাবিক শৈল্পিক নৈপুণ্য ছিল তাঁর কাজে। ‘বেলাশেষে’ ছবির এক দৃশ্য শ্যুট করার সময়ে, শটের শেষে জানিয়েছিলেন, দৃশ্যের প্রয়োজনে চোখের জল চোখেই ধরে রেখেছিলেন তিনি। যাতে বড়পর্দায় চোখের কোণের চিকচিকে-ভাব বোঝা যায়। তবে কেবলই কি অভিনয়? অভিনেতা ছাড়াও কবি, নাট্যকার, নির্দেশক, বাচিকশিল্পী, গদ্যকার হিসেবে তাঁর যে প্রতিভা, তার খোঁজ রাখেন ক’জন?
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় দূরের তারা ছিলেন না কোনোদিন। ছোটোবেলার বন্ধুদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল আজীবন। ২০২০ সালে তাঁর প্রয়াণের অল্পদিনের মধ্যেই প্রয়াত হন তাঁর স্ত্রী-ও। আকাশগঙ্গার পাড়ে বসে স্ত্রী-কে কি তিনি কবিতা শোনাচ্ছেন এখনো? কে জানে!