মানুষকে হাসাতে ভালবাসেন। বর্তমানে বাংলা স্ট্যান্ডআপ কমেডির অন্যতম নাম তিনি। অথচ আমি কিন্তু তাঁকে প্রথম চিনেছিলাম নাটকের মঞ্চে। ‘কলকাতা রমরমা’র নাটক ‘ডিজনিল্যান্ড’-এর ‘ধুকুপুকু’, শিলাদিত্য চ্যাটার্জীর সঙ্গে আড্ডা হল জমিয়ে।
স্ট্যান্ডআপ ভিডিও দেখলেও, নিজে কমেডি করার কথা কিন্তু আগে মাথাতেই আসেনি তাঁর। বাংলা ভাষায় কমেডিকে নিয়ে আসার জার্নি নিয়ে তো কথা হয়েছেই। তবে কথা হয়েছে আরো অনেক কিছু নিয়েই। সেসব বলতে বলতে হাসছিলেন শিলাদিত্য। বলছিলেন, ‘লাইফ আমার সঙ্গে ডার্ক কমেডি করেছে।’
উচ্চমাধ্যমিকের পরে আর পাঁচজনের মত জয়েন্ট পরীক্ষায় বসলেও, ইচ্ছে ছিল অঙ্ক নিয়ে পড়ার। তবে বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পরীক্ষা দিতেই পারেননি তিনি। কেন! কারণটা সেই ডার্ক কমেডিরই প্রথম অধ্যায়। শিলাদিত্য বলছিলেন, ‘Ankylosing Spondylitis’ নামে এক রোগ তাঁকে শয্যাশায়ী করে রেখেছিল মাসদুয়েক। ফলস্বরূপ, অঙ্কে অনার্স নেওয়ার ইচ্ছের ঘটেছিল অকালমৃত্যু। আর তারপরেই পাকেচক্রে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে প্রবেশ।
অনেকে বলেন, বিরহ না হলে নাকি ‘কমেডি আর কবিতা তেমন আসে না’। কিছুটা সেই ফর্মুলা মেনেই, বছরদুয়েক পর দর্শন মিলল কমেডির মোটিভেশন অর্থাৎ বিরহের। অবশ্য তার আগেই এক সিনিয়রের থেকে পেয়েছিলেন একটা কমপ্লিমেন্ট, ‘তুই তো বেশ ভাল কমেডি করিস, স্ট্যান্ডআপ করতে পারিস তো!’
কলেজ, পড়াশোনা, বিরহ সবমিলিয়ে একরকম জোর করেই তিনি শুরু করেছিলেন ওপেন মাইক। সালটা ২০১৮। বাংলায় করা প্রথম স্ট্যান্ডআপ হাততালি কুড়িয়েছিল কিছুটা অপ্রত্যাশিতভাবেই। আর আরো অপ্রত্যাশিতভাবে, তারপরেই ‘ডার্ক কমেডি’র দ্বিতীয় অধ্যায় হিসেবে এল ব্যর্থতা।
‘বাংলায় আবার কমেডি হয়!’ বলে নাক সিঁটকোন অনেকেই। শিলাদিত্য বলছিলেন, কিছু বছর আগে পর্যন্ত, সেই তালিকায় ছিলেন তিনিও। আর সেজন্যই হয়ত, প্রথমটা ছাড়া, প্রথমদিকের সব স্ট্যান্ডআপে তিনি বাংলাভাষার বদলে ব্যবহার করেছিলেন হিন্দি। কোভিডের পরে, বহুদিনের অনভ্যাসকে সঙ্গে নিয়ে হিন্দিতেই একটি শো করেছিলেন তিনি। আর সেই শো-তেই সামনে থেকে দেখেছিলেন ব্যর্থতাকে। ‘কমেডি করতে ভুলে গিয়েছি’ এমন ধারণাও ঘিরে ধরেছিল তাঁকে। ভেবেছিলেন, স্ট্যান্ডআপ করবেন না আর কোনোদিন।
অবশ্য সেই ভাবনা কিছুটা সত্যি। বেশ কিছু মাস পর থেকে আবার স্ট্যান্ডআপ করলেও, আর একদিনের জন্যও বাংলা ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় স্ট্যান্ডআপ করেননি শিলাদিত্য। শুনতে শুনতে আমার মনে প্রশ্ন এসেছিল, স্ট্যান্ডআপ ছেড়ে শিলাদিত্য ছিলেন কীভাবে! শুনলাম, ওই সময়েই অল্পস্বল্প আলাপ জমছিল ‘কলকাতা রমরমা’র সঙ্গে। স্ট্যান্ডআপের শূণ্যস্থানের বেশ কিছুটা পূরণ করেছিল থিয়েটার। কেবল তাই-ই নয়, স্ট্যান্ডআপের পরের ইনিংসেও সাহায্য করেছিল অভিনয়।
বাংলায় কমেডি হয় কিনা, তার হয়ত একটা বড় উত্তর এর মধ্যেই সকলকে দিয়ে দিয়েছেন শিলাদিত্য। বাংলা কমেডিজগতের অনেকেই অনুসরণ করছেন তাঁকে। স্ট্যান্ডআপ মানেই হিন্দি অথবা ইংরাজি, এমন ধারণায় বিশ্বাসী অনেকেই। শিলাদিত্য বলছিলেন, ‘সবাই তো স্ক্রিপ্টটা মাতৃভাষাতেই ভেবে তারপর অনুবাদ করে। তার বদলে যেটা ভাবছি, সেটা বলা তো অনেক বেশী ভাল!’
কমেডির জগতে বাংলাকে এগিয়ে অনেকটাই এগিয়ে দিয়েছেন তিনি। সেই সঙ্গে এগিয়েছেন নিজেও। বাংলায় স্ট্যান্ডআপ করেই বোধহয় সবচেয়ে বেশী জনপ্রিয়তা, সাফল্য এসেছিল তাঁর। এমনকি, স্ট্যান্ডআপের মঞ্চে ফেরত আসা একটা নতুন দল আর বাংলাভাষার হাত ধরেই। যদিও সেই দলও তিনি ছেড়েছিলেন কিছুদিন পরেই। এরপরে বন্ধু স্বর্ণজিতের সঙ্গে অর্গ্যানাইজ করেছেন নিজেদের শো। অপ্রত্যাশিতভাবে সিলেক্ট হয়েছেন আকাশবাণীতে। অভিনয় করেছেন বিভিন্ন ওটিটি প্ল্যাটফর্মেও। কিন্তু এখন তিনি যে জায়গায় রয়েছেন, সেটাই হয়ত তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় ‘অ্যাচিভমেন্ট’ আর ‘ডার্ক কমেডি’র যুগলবন্দী।
আড্ডার প্রথমেই জেনেছিলাম, এই মুহূর্তে কলকাতায় নেই শিলাদিত্য। রয়েছেন মায়ানগরীতে। কারণ আপাতত, তিনি চলতি আইপিএলের কমেন্ট্রি করছেন। স্ট্যান্ডআপের ভিডিও দেখেই অডিশনে ডাক পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু অডিশনের শেষ রাউন্ডের আগেই হাজির জীবনের ‘ডার্ক কমেডি’র চরমতম রাউন্ড।
অডিশনের শেষ রাউন্ডের দিনই তাঁর ঠাকুমাকেই ভর্তি করা হয়েছিল হাসপাতালে। ঠাকুমার ক্রমবর্ধমান অসুস্থতার খবর শুনতে শুনতে, তাঁর ঘরে বসেই অডিশন দিতে হয়েছে শিলাদিত্যকে। সেই অডিশনে সিলেক্ট হওয়ার পরেও, সামান্যতমও মসৃণ হয়নি পথ। দোলপূর্ণিমায় ঠাকুমার মৃত্যুর পরে, নিয়মভঙ্গের পরেরদিনই তাঁকে পাড়ি দিতে হয়েছে মুম্বইতে।
মুম্বইয়ের সেই বিলাসবহুল হোটেল থেকে কি শিলাদিত্য তাকিয়ে থাকেন রাতের আকাশের দিকে! বুঝতে পারেন, একটা তারার ঔজ্জ্বল্য বাকিদের তুলনায় বেশ কিছুটা বেশি! জিজ্ঞেস করা হয়নি। কিছু কথা হয়ত কল্পনায় আঁকা থাকাই ভাল!
বেথুন কলেজ থেকে উদ্ভিদবিদ্যায় স্নাতক। পড়ার নেশা ছোট থেকে, প্রাথমিকভাবে লেখালেখির শুরু শখেই। তারপর সংবাদপত্র, পত্র-পত্রিকায় সমালোচনা পড়ার অভ্যাস আর বিভিন্ন নাটক, সিনেমা দেখার পর বিশ্লেষণ করার শখ থেকেই ইচ্ছে সমালোচক হওয়ার। বিনোদনজগতের বিভিন্ন খবর করার পাশাপাশি নাটক এবং সিনেমা দেখে তার গঠনমূলক সমালোচনাও করেন তিনি।