Lojja Review: মৌখিক-মানসিক নির্যাতনের প্রথম জবাব
কিছু মানুষ আছেন, অপশব্দকে যাঁরা বাক্যের অলঙ্কার বলে মনে করেন। বাক্-স্বাধীনতার নামে, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে, উল্টোদিকের মানুষকে অসম্মান করা তাঁদের কাছে খুব স্বাভাবিক। কিন্তু সেই মানসিক নির্যাতনের প্রতিবাদ হয় কি কোথাও? মৌখিক এবং মানসিক নির্যাতন ঠিক কতটা ভয়ানক হতে পারে, তা নিয়েই হইচইয়ের নতুন ওয়েবসিরিজ, ‘SVF Entertainment Production’ প্রযোজিত, ‘লজ্জা’।
গার্হস্থ্য হিংসা বললে প্রথমেই মনে আসে শারীরিক নির্যাতনের কথা। ‘গায়ে হাত তোলার’ বিষয়ে সামান্য হলেও সচেতন হয়েছে মানুষ। কিন্তু স্পর্শ না করেও, দিনের পর দিন যে মানসিক নির্যাতন করা হয় কেবল কথা দিয়ে, সেগুলো কি নির্যাতন বলে গণ্য হয় আদৌ? বহুদিন ধরে চলে আসা এই ‘স্যাডিস্ট’ ঘটনাটা আপাতদৃষ্টিতে এতটাই স্বাভাবিক, যে নির্যাতিতরাও বুঝতে পারেন না, তাঁদের উপর অন্যায় করা হচ্ছে।
আর পাঁচটা সাধারণ মধ্যবিত্ত সংসারের মতই তথাকথিত ‘সাজানো-গোছানো’ সংসার পার্থ-জয়ার। এর মাঝে কাঁটার মত খচখচ করতে থাকে অপশব্দের প্রয়োগ। সন্তান, শাশুড়ি বা বাইরের লোক না বুঝলেও ভেতর থেকে ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ে জয়া (প্রিয়াঙ্কা সরকার)। কিন্তু ‘হাতে পায়ে ধরে হলেও সংসার বাঁচিয়ে নেওয়া’র এদেশে আদৌ কি লজ্জা পায় পার্থরা? নাকি তাঁদের অন্যায়ের কথা সর্বসমক্ষে বলতে লজ্জায় কুঁকড়ে যায় জয়ারাই?
ছয়পর্বের এই সিরিজে ক্রমাগত ‘ভার্বাল অ্যাবিউজ’-এর ঘটনা দেখতে দেখতে মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হবেন কোমলহৃদয়ের দর্শকেরা। হয়ত অর্ধসমাপ্তই রেখে দিতে ইচ্ছে হবে কারোর। লেখিকা সম্রাজ্ঞী বন্দ্যোপাধ্যায়ের করা সমীক্ষার উপর ভিত্তি করে তৈরী এই সিরিজের সার্থকতা ঠিক এখানেই।
কেবল শব্দ দিয়ে কতটা গভীর ক্ষত সৃষ্টি করা যায়, কতটা অসহনীয় নির্যাতন করা যেতে পারে কেবল মুখের কথায়, তা বোঝাতে সফল হয়েছেন পরিচালক অদিতি রায়। আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলা জয়ার ড্রয়িংরুম থেকে কাঠগড়ার ‘জার্নি’টা যত্ন করে সাজিয়েছেন তিনি।
পার্থ সিনহার ভূমিকায় আক্ষরিক অর্থেই দর্শকের কান গরম করেছেন অনুজয় চট্টোপাধ্যায়। এর আগে এমন চরিত্রে দেখা যায়নি তাঁকে। মাপা, সাবলীল অভিনয়ে তিনি তুলে ধরেছেন একেবারে অন্যধরনের, নেতিবাচক এই চরিত্রকে। প্রিয়াঙ্কাসহ প্রত্যেক কলাকুশলীর অভিনয়ই ভাল, তবে সবচেয়ে চোখ টেনেছেন স্নেহা চ্যাটার্জী, শাঁওলী চট্টোপাধ্যায় এবং ইন্দ্রাশিস রায়। স্বল্প পরিসরে বেশ ভাল কনীনিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ও।
নরম মনের অতিসাধারণ মেয়ে জয়া, আমাদের চারপাশে একেবারেই বিরল নয়। নারীস্বাধীনতা, নারী ক্ষমতায়নের যুগেও বহু মেয়ে কেবল সংসার বাঁচানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে মুখ বুজে। যদিও বাস্তবের পৃথিবীতে মেয়েদের পাশাপাশি ‘ভার্বাল অ্যাবিউজে’র শিকার বহু পুরুষও। দীর্ঘদিন ধরে হয়ে চলা মৌখিক অপমান যে আদতে কোনো স্বাভাবিক বিষয় নয়, অনেকের তা বোঝার ক্ষমতা তৈরীই হয়নি এখনো।
সিরিজের মূল বিষয় নিঃসন্দেহে সংবেদনশীল, তবে তারচেয়েও বড় ব্যাপার, এই বিষয় নিয়ে কাজ হয়নি এর আগে। অথচ রাস্তাঘাটে চলতে-ফিরতে প্রায়শই এমন মানুষজনের সঙ্গে দেখা হয় আমাদের। চারপাশের বহু চরিত্রকে দর্শক খুঁজে পাবেন এই ওয়েবসিরিজে। বাকি সব ছেড়ে দিলেও, কেবল এমন এক আপাতসাধারণ অথচ সংবেদনশীল বিষয় নিয়ে কথা বলা শুরু করার জন্যই কুর্নিশ প্রাপ্য নির্মাতাদের।