ভাল ছবি হলে, তার কাহিনী মনে থাকে আমাদের। মনে থাকে কিছু কলাকুশলী এবং পরিচালকের নাম। কিন্তু যাঁরা ক্যামেরার পিছনে থেকে সাহায্য করে চলেন পরিচালককে? সমস্ত ছবি জুড়ে ছড়িয়ে থাকে যাঁদের হাতের ছাপ? ছবির শেষে ছোট ছোট অক্ষরে দেখানো তাঁদের নাম কি আদৌ খেয়াল করি আমরা?
ছবির পিছনে থেকে কাজ করা একজন মানুষই এতদিন ছিলেন প্রসেনজিৎ বিশ্বাস। অঞ্জন দত্ত, কৌশিক গাঙ্গুলী মত পরিচালকদের বহু ছবিতে সহায়তা করেছেন পরিচালনায়। মৈনাক ভৌমিকের ছবিতে করেছেন সহযোগী পরিচালকের কাজ। এতদিন পরে, নিজে একটি অন্থোলজি ছবি তৈরী করছেন তিনি। ছবির নাম ‘#fairandugly’।
পাঁচটি গল্প নিয়ে বোনা এই ছবির তিনটি গল্পের শ্যুটিং হয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যে। খুব স্বাভাবিকভাবেই, এমন একটা ‘জার্নি’র গল্প জানার কৌতূহল হয় সকলেরই। জানতে ইচ্ছে করে, সাধারণ একজন মানুষ থেকে সহপরিচালকের সিঁড়ি পেরিয়ে, পরিচালক হয়ে ওঠার রাস্তাটা ঠিক কেমন ছিল তাঁর?
বাঙালিরা বাঙালিদের ভাল বন্ধু হয় না, এমন কথা শোনা যায় প্রায়শই। তবে প্রসেনজিতের অভিজ্ঞতা বেশ অনেকটাই অন্যরকম। আসলে কমবেশী সব মানুষই বোধহয় গল্প বলতে চায়, নিজের মত করে। প্রসেনজিৎ বিশ্বাসও তার ব্যতিক্রম নন একেবারেই। আর সেই চাওয়াতেই বোধহয় লুকিয়ে ছিল পরিচালক হয়ে ওঠার অঙ্কুর। গল্প বলার, ছবি বানানোর তাগিদে বাবার সঞ্চিত অর্থে হাত দিতে হয়েছিল তাঁকে। কিন্তু সেইসময়ে, তাঁর পাশে, তাঁর স্বপ্নের পাশে যাঁরা দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁরা তো প্রসেনজিতের বন্ধুই! প্রোডাকশন ম্যানেজার, অভিনেতা, অভিনেত্রী, কস্টিউম, ডিওপি, এডিটর – এঁরা প্রত্যেকেই তাঁর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে, একপয়সাও না নিয়ে, কাজ করে চলেছেন একবছরেরও বেশী সময় ধরে।
তাহলে কি ‘স্ট্রাগল’ করতেই হয়নি তাঁকে? অবশ্যই হয়েছে। এই ছবির পেছনে স্বাভাবিকের থেকে কিছুটা বেশী সময় দিতে হচ্ছে তাঁকে। পাশাপাশি স্বাভাবিকভাবেই আরো কিছু স্ট্রাগল করতে হয়েছে তাঁকে। কিন্তু সেই স্ট্রাগলকে ‘কষ্ট’-এর সমার্থক বলতে নারাজ প্রসেনজিৎ। পরিচালকের কথায়, ‘স্ট্রাগল শব্দটার মধ্যে অদ্ভুত একটা নেগেটিভ অর্থ জড়িয়ে আছে। স্ট্রাগল তো আমরা সম্পর্কেও করি। তা বলে কি বেঁচে থাকছি না? ছবি বানানো তো একটা সম্পর্কের মতই!’ তাঁর মতে, কলকাতা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি পাশে রয়েছে তাঁর। তাঁর ডাকে সাড়া দিয়েছেন বহু নামীদামী, এমনকি জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত কলাকুশলীরাও।
বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি সবরকম ভাষাই মিশে রয়েছে তাঁর নতুন ছবিতে। ডেবিউ ছবিতেই হঠাৎ এমন ‘এক্সপেরিমেন্ট’? আসলে ভাষার কাঁটাতার মুছে ফেলতে চান প্রসেনজিৎ। সবধরনের দর্শকের মন স্পর্শ করতে চান তিনি। নিজে কোনোদিন বাংলা মাধ্যম স্কুলে পড়েননি পরিচালক। কিন্তু বাংলার চর্চা ছিল তাঁর বাড়ীতে। সেই চর্চা আর পাঁচজন বাঙালির চেয়ে হয়ত কিছুটা বেশীই রক্তে মিশেছে তাঁর। সেকারণেই হয়ত তাঁর মুখ থেকে বেরিয়ে আসে, ‘সবাই বাঙালিকে গালাগাল দেয়। বাঙালির এত গালাগাল দেওয়ার কী আছে? বম্বে ও বিদেশ থেকে যে অভিনেতা-অভিনেত্রী ও কলাকুশলীরা আসছেন আমি বাঙালি জেনেও, আমার কলকাতাতেই, That’s a big honor for me indeed in lieu of peanuts.’
ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, পার্ণো, সম্রাট, সিদ্ধার্থ মেনন, মুমতাজের মত অভিনেতা-অভিনেত্রীরা রাজী হয়েছেন এককথায়। কেবল তাই নয়, খুশী-খুশী গলায় পরিচালক জানালেন, ‘কলকাতা থেকে প্রথম অন্থোলজি (এক মুঠো ছবি) বেরিয়েছিল আঠার-উনিশ বছর আগে। সেই ছবিতে যাঁরা কাজ করেছিলেন, তাঁরা অনেকেই আমার ছবির অংশ। জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত অভিনেতা-অভিনেত্রীকে পরিচালনা করা আমার পাওনা-প্রাপ্তি নয়, বড়দের আশীর্বাদ।’
কষ্টের চেয়ে, ‘স্ট্রাগল’-এর চেয়ে পজিটিভ কথাই বলতে পছন্দ করেন পরিচালক। কথার শেষে মনে করালেন ‘চৈতীদির (চৈতী ঘোষাল) কথা লিখো, খুব সাপোর্ট করছেন দিদি।’ অতিমারী অনেকের থেকে অনেককিছুই নিয়ে গিয়েছে। তাঁকে দিয়ে গিয়েছে জীবনীশক্তি। তাঁর কথায়, ‘বেঁচে আছি, এটাই তো অনেক! যা করছি, তা ঈশ্বরের আশীর্বাদে, আর এই মানুষগুলোর সাপোর্টে।’
যে সময়ে ধনাত্মকতা প্রায় বিদায় নিয়েছে জীবন থেকে, ধনাত্মকতার জায়গা নিচ্ছে ট্রোল, ‘বুলিং’য়ের মত বিষয়, সে সময় একজন প্রসেনজিৎ বিশ্বাসের প্রয়োজন। যিনি বুক ঠুকে বলতে পারবেন, ‘আমি কারোর সঙ্গে খারাপ কাজ না করলে, কেউ আমার সঙ্গে রাজনীতি করবে কেন? আমার মধ্যে রাজনীতি না থাকলে কেউ আমার সঙ্গে রাজনীতি করবে না।’