প্রথম বিশ্ব, তৃতীয় বিশ্ব নির্বিশেষে সব রাষ্ট্রেরই বেশকিছু সাধারণ সমস্যা থাকে। যে সমস্যাগুলো কাটিয়ে ওঠার সদিচ্ছার হদিশ হয়ত অনেকক্ষেত্রেই পাওয়া যায় না। আর তেমনই একটা সমস্যা এই উদ্বাস্তু সমস্যা।
সম্প্রতি ‘দক্ষিণ দমদম সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র’ প্রযোজিত নাটক ‘বাদাবন’ দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, উদ্বাস্তুদের সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামানোর চেয়ে, উদ্বাস্তুদেরকেই সমস্যা ভেবে নেওয়া হয়ত সহজ অনেকটাই। আর সেকারণেই, চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বছর আগের মরিচঝাঁপির সঙ্গে কোনো পার্থক্য পাওয়া যায় না বর্তমান ইউরোপ, মায়ানমার, প্যালেস্তাইন, গাজ়ার।
স্বাভাবিকভাবেই, সুন্দরবনের মানুষের সঙ্গে বাঘের সম্পর্কটা ঠিক ‘চিড়িয়াখানা’র নয়। বাঘ দেখে শহরের মানুষ সর্বাধিক যতটা উৎফুল্ল হতে পারেন, তার চেয়ে কয়েককোটি গুণ বেশী আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে সুন্দরবনবাসীর মনে। আর এর সঙ্গেই একটা অদ্ভুত, অবিশ্বাস্য অথচ তীব্র বাস্তব সম্পর্ক রয়েছে ১৯৭৯ সালের ৩১শে জানুয়ারির। মাস্টারকাকা নামে নাটকের একটি চরিত্রের মুখ থেকে জানা যায়, দণ্ডকারণ্যে ‘পুনর্বাসন’ দেওয়া সত্ত্বেও, সরকারি নির্দেশ অমান্য করে মরিচঝাঁপিতে বসবাস করার অপরাধে তাঁদের উপর অত্যাচার শুরু করে ‘পুলিশের ভাড়াটে গুন্ডারা’। দিনের পর দিন খাবার-জল বন্ধ করে দেওয়া হয় তাঁদের। নদী পেরোতে গেলে গুলি করে মারা হয় তরুণদের। অনাহারে মারা যান অনেকে। আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয় তাঁদের ঘরের চালে।
ফলস্বরূপ মরিচঝাঁপিকে উদ্বাস্তুশূন্য হয়ত করা গিয়েছে সত্যিই। কিন্তু মন্টু, মন্টুর মায়ের মত অসংখ্য বাদাবনবাসীর মনের আগুন নেভানো গিয়েছে কি? জলে ভাসিয়ে দেওয়া মৃতদেহের মাংস খেয়েই বাঘের হিংস্রতা বেড়েছে, এ ধারণা জন্ম নিয়েছে তাদের মনে। বাঘ এবং উচ্চবর্ণের, শাসকশ্রেণীর মানুষ – দুইয়ের প্রতিই বিদ্বেষ জন্মেছে সমানমাত্রায়। আর এই সমস্ত প্রেক্ষাপটটিই অতিযত্নে দর্শকের সামনে সাজিয়ে দিয়েছেন কাহিনীকার সুদীপ সিংহ এবং নির্দেশক পৃথ্বীশ রানা। মন্টু নস্কর, যমুনা নস্করের লড়াই বাঘের সঙ্গে না মানুষের সঙ্গে, বাঘের হিংস্রতা বেশী নাকি মানুষের, সব হিসেবই যেন গুলিয়ে যায় নাটকের শেষে।
নির্দেশক জানিয়েছিলেন, একঝাঁক তরুণ সদস্যের উপর ভরসা করেছিলেন তিনি। বলাই বাহুল্য, নির্দেশকের এমন অনন্য সিদ্ধান্তের মান রেখেছেন প্রত্যেকে। কারোর অভিনয় দেখে বোঝার উপায় নেই যে, এই নাটকেই প্রথম মঞ্চে অভিনয় করছেন তাঁরা। প্রত্যেকের সাবলীল উচ্চারণ, শরীরী ভঙ্গিমা, সংলাপ বলার কায়দা যেন মাথা উঁচু করে দাবী জানায় প্রশংসার। তবে বিশেষ করে বলতেই হয় নীলাঞ্জন গঙ্গোপাধ্যায় এবং পান্না মণ্ডলের কথা। অভ্র দাশগুপ্তের আলোকসজ্জা ও মঞ্চসজ্জা অনবদ্য। কেবল সুন্দরবনের জনজাতিকে নয়, গোটা সুন্দরবনকেই যেন মঞ্চে তুলে আনা হয়েছিল। পায়েসের কাজু-কিশমিশ বা কেকের উপরের চেরির মত মনে রয়ে গিয়েছে অভিজিৎ আচার্য্যের সঙ্গীত।
এমন সংবেদনশীল একটি নাটক দেখেও যেন মন খুঁতখুঁত করে সামান্য। যাদবপুরের যুক্তিবাদী, স্পষ্টভাষী ছেলেটির আত্মোপলব্ধির প্রক্রিয়াটি যেন বড় দ্রুত ঘটল। তাছাড়া, মরিচঝাঁপির কলঙ্কিত অধ্যায়ের বুক চিরে কি মাঝেমধ্যে উঁকি দিল বাম সরকারের প্রতি তীব্র বীতশ্রদ্ধ মনোভাব? তবে এ নেহাতই ব্যক্তিগত উপলব্ধি। দর্শকভেদে তার অমিল হওয়া নিতান্ত স্বাভাবিক।
‘বাদাবন’-এ কেবলই উদ্বাস্তু সমস্যা তুলে ধরেননি কলাকুশলীরা। তুলে ধরেছেন ‘বাঘের মানুষীকরণ’-এর মত আশ্চর্য বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব, তুলে ধরেছেন সুন্দরবনের মানুষদের মনস্তত্ত্ব, তুলে ধরেছেন সম্প্রীতির পলকা মোড়ক জড়ানো বর্ণভেদের প্রথা, তুলে ধরেছেন জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে শাসকশ্রেণীর নির্লজ্জ ‘ইগো’র বহিঃপ্রকাশ। প্রশ্ন তুলেছেন, আদৌ কি কোনোদিন নিজের দেশের মানচিত্র নিজেরা আঁকতে পারবে সাধারণ মানুষ?
এই রিলস-শর্টসের যুগে, এই ‘থ্রি সেকেন্ড পলিসি’র যুগে দু’ঘন্টার বেশী সময় দর্শককে আসনে বসিয়ে রাখা কম শক্ত কাজ নয়। অথচ সে কাজটাই অবলীলায় করে দেখিয়েছেন প্রত্যেক কলাকুশলী। প্রায় আড়াইঘণ্টার এ নাটকের হাহাকারের অনুরণন কি থেকেই যাবে নাগরিকত্বের অনিশ্চয়তায় ভোগা জনগণের মনে? প্রশ্ন থেকেই যায়।