রাজনীতির প্রতি শিক্ষিত বাঙালির বিতৃষ্ণা বরাবরের। অথচ রাজনৈতিক নেতার অশিক্ষা যে রাষ্ট্রকে কোন অতলে তলিয়ে দিতে পারে, তা বোঝা কি আদৌ কঠিন!
গতকাল অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসের মঞ্চে অভিনীত হয়েছে লিলুয়ার ‘প্রগতি’ নাট্যদলের প্রযোজনা ‘সন্দীপনী’। এক আচমকা অবসরে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক দীপক বসু তাঁর ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে আড্ডায় মাতেন রাজনীতি নিয়ে। কথায় কথায় তাঁরা পৌঁছে যান ব্যক্তি এবং মতাদর্শের পার্থক্যের তাত্ত্বিক আলোচনায়। মতাদর্শ দৃঢ় হলে, মনের সদিচ্ছা থাকলে, ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছেও যে জনসাধারণের কথা ভাবা সম্ভব, তা বোঝাতে গিয়ে গল্পচ্ছলেই চে গেভারার উদাহরণ দেন তিনি।
কঙ্গোয় পরাজয়ের পর, চে লুকিয়েছিলেন তানজানিয়ায়। প্রবলভাবে তিনি অনুভব করছেন স্ত্রী এ্যালাইডা এবং চার সন্তানের অভাব। এ্যালাইডা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসেন গোপনে। চে জানান, কঙ্গোর পরাজয় তাঁর মনোবল ভাঙতে পারেনি। ফের স্বৈরতান্ত্রিক শাসকের অবসানের লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে চান তিনি। বলিভিয়ায় ছড়িয়ে দিতে চান বিপ্লব।
কিন্তু এখানেও এক ছাত্রের মনে থেকে যায় প্রশ্ন। চে কি আদৌ সাম্য ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন! নাকি ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন উগ্রপন্থা! প্রথম বিশ্বের দেশ আমেরিকা, চে-কে তকমা দিয়েছে উগ্রপন্থীর। কিন্তু সশস্ত্র বিপ্লবী হলেই কি তাকে উগ্রপন্থী আখ্যা দেওয়া যায়?
অভি সেনগুপ্ত (অধ্যাপক), মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায় (অধ্যাপিকা রাণু বসু) এবং সুস্নাত ভট্টাচার্য্যের (চে গেভারা) অভিনয়ের কথা আলাদাভাবে বলতেই হয়। তবে স্বল্প পরিসরে মন কেড়েছেন অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় (রাধেশ্যাম টোডী)। দেবব্রত মাইতির ছিমছাম মঞ্চসজ্জা এবং সঙ্গীতা পালের পোশাক পরিকল্পনাও উল্লেখের দাবি রাখে।
এধরনের বিতর্কিত, রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে নাটক লেখার জন্য কুর্নিশ নাট্যকার অনির্বাণ সেনকে। অভিনয়ের ক্ষেত্রে দু-একটি জায়গায় কো-অর্ডিনেশনের সামান্য অভাববোধ করলেও, নাটকের গতি সে রেশ মুছে ফেলে মন থেকে। ১৬টি প্রামাণ্য বই ঘেঁটে এবং আরো বেশ কিছু সূত্র ব্যবহার করে এ নাটক লিখেছেন তিনি।
যে মানুষটি মারা গিয়েছেন পাঁচ দশকেরও বেশী সময় আগে, যাঁর মতাদর্শের আর অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যায় না, তাঁকে নিয়ে আমেরিকার মত দেশ কেন এত চিন্তিত, কেন এখনো চে-কে নিয়ে প্রচার (ব্যক্তিবিশেষের মতে অপপ্রচার) চালিয়ে যাচ্ছে তারা, সে প্রশ্নও মনে জাগায় এ নাটক।
নাট্যদলের জন্মদিন উপলক্ষ্যে এমন বিতর্কিত রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে লেখা নাটকই মঞ্চস্থ করার কথা ভাবা হল কেন? নাটকের শেষে পরিচালক আবীর ঘোষকে এ প্রশ্ন করায় তিনি বলেন, ‘এই নাটকটা আমাদের প্রতিদিনই মনে হয় ভীষণ প্রাসঙ্গিক। আর তাছাড়া আমাদের জন্মদিনের থেকেও বেশী গুরুত্বপূর্ণ হল, সামনে আমাদের দেশের সাধারণ নির্বাচন। যে ভাবনা থেকে নির্বাচকরা ভোট দেন, যদি এই নাটক তাঁদের সেই ভাবনাকে আরেকটু শানিত করতে পারে, আরেকটু শিক্ষিত করতে পারে, সেই জন্যই এটা বেছে নেওয়া।’
আসলে সব বিষয়ে শিক্ষা নেওয়া হলেও, কোনো এক অজানা কারণে রাজনৈতিক শিক্ষাটাই নেওয়া হয়ে ওঠে না আমাদের। চে গেভারা আদৌ মহান নাকি উগ্রপন্থী, তা তর্কসাপেক্ষ। তবে তাঁর মতাদর্শের উপর কোনো তর্ক চলে কি?
রাজনীতির প্রতি এই অনীহা যতদিন সতর্কভাবে বজায় রাখবে মানুষ, হয়ত ততদিনই ‘সবার উপরে ক্ষমতা সত্য’র গান গাওয়া হবে চূড়ান্ত নির্লজ্জভাবে!
বেথুন কলেজ থেকে উদ্ভিদবিদ্যায় স্নাতক। পড়ার নেশা ছোট থেকে, প্রাথমিকভাবে লেখালেখির শুরু শখেই। তারপর সংবাদপত্র, পত্র-পত্রিকায় সমালোচনা পড়ার অভ্যাস আর বিভিন্ন নাটক, সিনেমা দেখার পর বিশ্লেষণ করার শখ থেকেই ইচ্ছে সমালোচক হওয়ার। বিনোদনজগতের বিভিন্ন খবর করার পাশাপাশি নাটক এবং সিনেমা দেখে তার গঠনমূলক সমালোচনাও করেন তিনি।