বিশ্ব কেন, খেলা নিয়ে কেবল বাংলাতেও খুব কম ছবি তৈরী হয়নি। কিন্তু দাবা খেলা নিয়ে? উত্তর সহজ, একটাও না। পথিকৃৎ বসুর হাত ধরে চলচ্চিত্রজগতের ইতিহাসে প্রথমবার পা রেখেছে এই খেলা। কেমন হল তাঁর নতুন ছবি ‘দাবাড়ু’?
রাষ্ট্র থেকে সাধারণ মানুষ, সকলে একজন খেলোয়াড়কে দেখে, তাঁর খেলা দেখে। সে ভাল খেললে বাহবা দেয়, খারাপ খেললে খোরাক হয়। কিন্তু খেলোয়াড় তৈরী হওয়ার সময়ে ঠিক কতগুলো জীবন জুড়ে থাকে তাঁর সঙ্গে, সে খোঁজ কি রাখে কেউ? কতটা অপমান, জ্বালা, চোখের জল-ঘাম-রক্ত জুড়ে থাকে সেই ইতিহাসের সঙ্গে, সে খবর না রাখাটাই দস্তুর। সেসব তাঁরা মেনেই নেন নির্দ্বিধায়। কিন্তু স্বয়ং কোচের মুখ থেকে যদি শোনা যায়, উত্তর কলকাতার রক থেকে দাবাড়ু হয়ে ওঠা যায় না, মনোবল কি অটুট থাকতে পারে তখনো!
‘গ্র্যান্ডমাস্টার’ সূর্যশেখর গাঙ্গুলীর জীবন থেকে অনুপ্রাণিত এ ছবি। ছোট্ট সৌর (সমদর্শী সরকার) দাদুর (দীপঙ্কর দে) হাত ধরে খেলাচ্ছলে ঢুকে পড়ে চৌষট্টি খোপের কুরুক্ষেত্রে। দাবা খেলতে জানা মা (ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত) আর দাদুই তার দাবা খেলার সহজপাঠ। নিজের অজান্তেই সে দক্ষতা দেখাতে শুরু করে দাবার বোর্ডে। অবলীলায় হারিয়ে দেয় প্রাজ্ঞ-বয়স্কদেরও। অবশ্য পাড়ার প্রতিযোগিতার সময়ে সমস্যা তেমন বাড়েনি।
সমস্যা শুরু হয়, যখন আচমকাই সেই লড়াই চৌষট্টি খোপ ছাড়িয়ে সৌরকে নামিয়ে আনে জীবনের ময়দানে। বাড়ী বয়ে এসে পাওনাদারদের তাগাদা, প্রশিক্ষক বদল, প্রেমিকার মায়ের তিরস্কার – সবকিছু যেন তাকে উদ্ধত করে তোলে ধীরে ধীরে। দাদুর মৃত্যু তাকে দূরে সরিয়ে দেয় মায়ের থেকেও।
সেই কঠিন পরিস্থিতি থেকে কীভাবে বেরিয়ে আসবে সৌর! কীভাবেই বা সে ফিরবে জেতার খেলায়! মধ্যবিত্ত পরিবারের সংগ্রাম, সাধারণ মানসিকতা, কলহপ্রিয় পড়শির জ্বালাতন, সবটাই পথিকৃৎ বসু তুলে ধরেছেন খুব স্পষ্টভাবে। কীভাবে সমাজ একটা শিশুকে বুঝিয়ে দেয় তার বাবার (শঙ্কর চক্রবর্তী) ‘বেকারত্ব’, যত্নবান প্রশিক্ষক (চিরঞ্জিৎ চক্রবর্তী) বদলে আচমকা কড়া প্রশিক্ষকের (কৌশিক সেন) হাতে পড়লে সেরা দাবাড়ুও যে কতটা অসহায় হয়ে পড়ে, ভাল লেগেছে সেই দৃষ্টিভঙ্গিগুলোও।
ছোট্ট সৌরর যেন চরিত্রে সমদর্শী বড় সাবলীল, ভাল অভিনয় করেছে অর্ঘ্য বসু রায়ও। শঙ্কর চক্রবর্তী, খরাজ মুখোপাধ্যায়, কৌশিক সেন, ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত-সহ প্রত্যেককেই নিজেদের চরিত্রে বেশ ভাল লেগেছে। তবে দাবার সেরা চালটা দিয়েছেন চিরঞ্জিৎ চক্রবর্তী এবং দীপঙ্কর দে। কয়েকটি দৃশ্যে অতিরঞ্জনের ছোঁয়া থাকলেও, সামগ্রিকভাবে ছবির মূলভাবের ক্ষতি করেনি তা। বিশ্বনাথ বসু আর সঙ্ঘশ্রী সিনহার অভিনয় বেশ নজরকাড়া l
প্রসেন বনি চক্রবর্তীর সঙ্গীত পরিচালনায় ছবির গানগুলো জমেছে বেশ। ছবির চিত্রনাট্য লিখেছেন অরিত্র ব্যানার্জী এবং সংলাপ লিখেছেন অর্পণ গুপ্ত। বেশ জমাটি হয়েছে সেদু’টিও। ছবিটা দেখার পর, একটা প্রশ্ন বিঁধেই থাকে মনে। মধ্যবিত্ত পরিবারে এখনো কি গ্রহণযোগ্য হয়েছে দাবা? জুয়ার সঙ্গে আর তুলনা টানা না হলেও, এখনো কি কিছুটা ব্রাত্য নয় এই ‘রাজার খেলা’! এই ছবি দেখে যদি অনুপ্রাণিত হয় একজনও, সেটাই হয়ত হবে নন্দিতা রায়-শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়-পথিকৃৎ বসুর সবচেয়ে বড় পুরস্কার।
বেথুন কলেজ থেকে উদ্ভিদবিদ্যায় স্নাতক। পড়ার নেশা ছোট থেকে, প্রাথমিকভাবে লেখালেখির শুরু শখেই। তারপর সংবাদপত্র, পত্র-পত্রিকায় সমালোচনা পড়ার অভ্যাস আর বিভিন্ন নাটক, সিনেমা দেখার পর বিশ্লেষণ করার শখ থেকেই ইচ্ছে সমালোচক হওয়ার। বিনোদনজগতের বিভিন্ন খবর করার পাশাপাশি নাটক এবং সিনেমা দেখে তার গঠনমূলক সমালোচনাও করেন তিনি।