ট্রেলার দেখেই বোঝা গিয়েছিল, এ ছবির ইউএসপি হতে চলেছে আবীর চট্টোপাধ্যায়, পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের রসায়ন। কিন্তু ছবিটা দেখে বোঝা গেল, কোনো এক-দু’জনের নয়, আসলে সকলের সঙ্গে সকলের রসায়নই রীতিমত জমে গেছে এই ছবিতে।
চূড়ান্ত বিক্ষুব্ধ একজন ডিটেকটিভ। তথাকথিত ‘রুচিশীল’ বাঙালী এবং তাদের গতে বাঁধা পছন্দের উপর যাঁর অপরিসীম রাগ, শহরে বিপজ্জনক টেররিস্ট গ্যাং এসেছে জেনেও যাঁর মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া জাগে না, চোখের সামনে একজনকে মারা যেতে দেখেও যে বসে থাকে নিতান্ত নিস্পৃহভাবে, তাকেই শেষপর্যন্ত ফিরতে হয় ‘বাদামী হায়না’কে আটকাতে। দীপক চ্যাটার্জীর ভূমিকায় আবীরকে দেখতে দেখতে একবারও মনে পড়েনি ফেলুদা, ব্যোমকেশ কি সোনাদার চরিত্রে তাঁর অভিনয়ের কথা। মনপ্রাণ দিয়ে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করেছে, ইনিই সেই বিস্মৃত ডিটেকটিভ, যাঁকে নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করতে বারংবার শুঁকতে হয় ন্যাপথলিনের গন্ধ।
একই কথা প্রযোজ্য পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্যও। স্রষ্টা আর সৃষ্টির কথা কাটাকাটি, খুনসুটি, মনোবল যোগানো – এককথায় পুরো রসায়নটাই তাঁদের পর্দার বাইরের জগতে বাস্তব করে তুলেছে এই একুশ শতকেও। আর এখানেই বোধহয় দেবালয় ভট্টাচার্য্যের সাফল্য। দীপকের দাবীতে স্রষ্টা নিজের পাণ্ডুলিপি বদলান বারংবার, স্বভাববিরুদ্ধ অথচ সাবলীলভাবে যোগ করেন রবীন্দ্রসঙ্গীত, ইতিহাস। দীপকের প্রতি রতনলালের (প্রতীক দত্ত) ভালোবাসা থাকা সত্ত্বেও নিজের কর্তব্যের প্রতি তাঁর দায় মুগ্ধ হওয়ার মত। তাসির চরিত্রে শ্রুতি দাসও অভিনয়ের জমি ছাড়েননি বিন্দুমাত্র।
তাছাড়া, শাঁওলি চট্টোপাধ্যায় (মিস নন্দী), গৌতম হালদার (বাজপাখি), লোকনাথ দে (দীপেন্দ্রনারায়ণ), সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় (আঙ্কল রজার) – প্রত্যেকেই নিজের নিজের চরিত্রে অনবদ্য। স্বল্প পরিসরে সন্দীপ ভট্টাচার্য (বিজ্ঞানী) আবারও চিনিয়েছেন নিজের জাত। মন কেড়েছে শিশুশিল্পী আশমান দত্তের (অমলতাস) অভিনয়ও।
তবে কেবল অভিনয়ের কথা বললে, নেহাতই অন্যায় হবে। দেবালয় ভট্টাচার্য্যের লেখা সংলাপে মাঝেমধ্যেই যেমন হাসির রোল উঠেছে, তেমনি কিছুক্ষেত্রে চাবুকও পড়েছে সমাজের পিঠে। রম্যদীপ সাহার ক্যামেরা এবং অমিত চ্যাটার্জীর গানে সমৃদ্ধ হয়েছে এ ছবি। বেশ অন্যরকম লেগেছে ‘হ য ব র ল’ বা ‘পথের পাঁচালী’-র রেফারেন্সও।
দেবালয় চেয়েছিলেন, এ ছবির মাধ্যমে স্বপনকুমার-দীপক চ্যাটার্জীর শহরটাকে আরো একবার ফিরিয়ে আনতে। সে কাজে তিনি সফল। বরং বখশিশস্বরূপ, ছবির ক্লাইম্যাক্সে তিনি দর্শকদের উপহার দিয়েছেন এক অভাবনীয় প্লট টুইস্ট। তাছাড়া, বারবার কিছু কিছু সংলাপ, গানের পঙক্তি, ‘ফ্ল্যাশব্যাক-ইন্টারভ্যাল’ প্রভৃতি লেখার ধরনও বারবার মনে করাচ্ছিল কমিক্স বইয়ের পাতা। তবে এতকিছু সত্ত্বেও, ‘কোনো কিছুই ১০০% সঠিক হয় না’ শর্ত মেনে সামান্য কিছু বাড়তি দৃশ্যের উপস্থিতিদোষে দুষ্ট এই ছবি। তাছাড়া, দীপেন্দ্রনারায়ণের পুরোনো বইয়ের ট্রাঙ্কে থাকা স্বপনকুমারের বই দেখে মনেই হয় না যে সেটা তেমন ‘পুরনো’!
কিন্তু ছবি দেখতে দেখতে মনেই থাকে না এইটুকু খুঁতের কথা। তাছাড়া, সেই যে, স্বপনকুমার বলেছেন, তাঁর গল্পে লজিক নেই, ম্যাজিক আছে। আশা করা যায়, এই ইঁদুরদৌড়ের যুগে বসেও, সেই ম্যাজিক দেখতে হলমুখী হবে বাঙালী।